ক্যাডেট কলেজসমূহের সাফল্য

যুক্তরাজ্যের পাবলিক স্কুলের আদলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ১৯৫৮ সালে সাগর বিধৌত চট্টগ্রামের ফৌজদারহাটে, ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়। নিউজিল্যান্ড থেকে আগত স্যার উইলিয়াম মরিস ব্রাউন প্রথম অধ্যক্ষ হিসেবে নিয়োগ প্রাপ্ত হন। ক্রমান্বয়ে ১৯৬৩ সালে ঝিনাইদহ ক্যাডেট কলেজ, ১৯৬৫ সালে মির্জাপুর ও রাজশাহী ক্যাডেট কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়।

ক্যাডেট কলেজের সাফল্যের প্রেক্ষিতে স্বাধীনতা পরবর্তীকালে ১৯৭৮ সালে সিলেট ক্যাডেট কলেজ, ১৯৭৯ সালে রংপুর ক্যাডেট কলেজ, ১৯৮১ সালে বরিশাল ও পাবনা ক্যাডেট কলেজ, ১৯৮৩ সালে ময়মনসিংহ গার্লস ক্যাডেট কলেজ ও কুমিল্লা ক্যাডেট কলেজ এবং ২০০৬ সালে জয়পুরহাট গার্লস ক্যাডেট কলেজ ও ফেনী গার্লস ক্যাডেট কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়। এখানে উল্লেখ্য যে ১২টি ক্যাডেট কলেজের মধ্যে ৯টি ছেলেদের এবং ৩টি মেয়েদের জন্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।

জনগণের দাবীর প্রতি লক্ষ্য রেখে এবং ক্যাডেট কলেজের ক্রমবর্ধমান সাফল্যে ক্যাডেট কলেজের সংখ্যা বাড়ানোর ক্ষেত্রে সরকারি নির্দেশনা অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়ে। জাতির আশা আকাঙ্ক্ষার দিকে লক্ষ্য রেখে সকলে ক্ষেত্রে নেতৃত্ব প্রদানের লক্ষ্যে ক্যাডেটদের প্রশিক্ষিত করা হয়।

ক্যাডেট কলেজের ক্যাডেটগণ শুরুতে সশস্ত্র বাহিনীতে যোগদানে অনুপ্রাণিত হলেও পরবর্তীকালে জাতির অন্যান্য ক্ষেত্রে অবদানের প্রয়োজনীয়তা দেখা দিলে তারা তাদের কর্মক্ষেত্র বিভিন্ন দিকে বিস্তৃত করে। এর ফলে মেধাসম্পন্ন এই ক্যাডেটগণ সশস্ত্রবাহিনীসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে শীর্ষ পর্যায়ের স্থানটি আরোহণ করে তাদের অবদান রেখে চলেছেন।

ক্যাডেট কলেজের প্রাত্যহিক কার্যক্রমের মূল অংশ সমূহে রয়েছে শারীরিক অনুশীলন, বিভিন্ন খেলাধুলায় অংশগ্রহণসহ সহশিক্ষা কার্যক্রম। ৭ম শ্রেণিতে আগত ক্যাডেটকে আত্মনির্ভরশীল করে গড়ে তোলার নিবিড় প্রশিক্ষণ ক্যাডেট কলজে প্রদান করা হয়। চরিত্র গঠন, ধর্মের প্রতি অনুরাগ সৃষ্টি করা হয় প্রাত্যহিক ধর্মীয় অনুশীলন এবং বাৎসরিক কেরাত প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের মাধ্যমে।

স্বাস্থ্য সচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে নিয়মিতভাবে স্বাস্থ্য পরীক্ষার অংশগ্রহণ বাধ্যতামূলক। সুকুমার বৃত্তিগুলো পরিস্ফুটনের লক্ষ্যে সংগীত, সাহিত্য ও বিতর্ক প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় ক্যাডেটগণ অংশগ্রহণ করে তাদের অভিজ্ঞতা বিনিময়ের এক বিরল সুযোগ লাভ করেন। আন্তঃ ক্যাডেট কলেজ ক্রীড়া, সাহিত্য ও সংগীত প্রতিযোগিতায় অংশ গ্রহণ করে সারা বছরব্যাপী ব্যস্ত থাকেন ক্যাডেট কলেজের ক্যাডেটগণ।

নিয়মানুবর্তিতা ক্যাডেট জীবনকে ঘিরে রাখে। ছুটি ছাড়া বছরের বাকি দিনগুলো একজন ক্যাডেট অভিভাবকদের পরম স্নেহ থেকে দূরে থাকলেও অধ্যক্ষ, অ্যাডজুডেন্ট, মেডিক্যাল অফিসার ও অনুষদ সদস্যবৃন্দের সাহচর্যে তাদের জীবন অতিবাহিত হয়ে থাকে। ৬ বছরের শৃঙ্খলাপূর্ণ জীবন একজন ক্যাডেটকে পরিপূর্ণ মানুষ হতে সাহায্য করে।

ক্যাডেট কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো যুবকদের মাঝে উচ্চতর নৈতিকতা, মানসিক দৃঢ়তা, মনোবল, শারীরিক শক্তি ও দূরদৃষ্টি সম্পন্ন মানুষের গুনাবলি প্রোথিত করতে। ইতিমধ্যেই দেখের প্রচলিত আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থার সমস্ত উপকরণ ক্যাডেট কলেজের পাঠক্রমে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।

স্বাধীনতার পরবর্তীকালে বাংলা মাধ্যমে শিক্ষাদান শুরু হলেও ২০০৩ সাল থেকে ইংরেজি মাধ্যমে পাঠদান শুরু হয়েছে। বিভিন্ন বিদ্যায়তনে বর্তমানে প্রবর্তিত মাল্টিমিডিয়া ব্যবস্থা বহু আগেই ক্যাডেট কলেজ প্রবর্তিত হয়েছিলো। ক্যাডেট কলেজে রয়েছে বিজ্ঞানাগার, রয়েছে ভাষা গবেষণাগার এবং জ্ঞান আহরণের জন্য আধুনিক পাঠাগার। শিক্ষা সফর ক্যাডেটদের দেশের ঐতিহাসিক নিদর্শন ও স্থাপনা সম্পর্কে বিস্তর জ্ঞান অর্জনের সুযোগ এনে দেয়।

প্রত্যন্ত অঞ্চলে স্থাপিত ক্যাডেট কলেজসমূহের ক্যাডেটদের নির্ভর করতে হয় নিবেদিত প্রাণ অনুষদের সদস্যদের উপর। দেশের অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্রছাত্রীদের মত ক্যাডেট কলেজের ছাত্রছাত্রীদের কোচিং এ অংশগ্রহণের সুযোগ খুব কমই হয়ে থাকে। এতদসত্ত্বেও ক্যাডেট কলেজের ছাত্রদের নিয়মিত অধ্যয়ন ও সময়ানুবর্তীকে পুঁজি করে তাদের সাফল্য ছিনিয়ে আনতে হয়েছে।

আজ তাই নির্দ্বিধায় বলা যায় যে দেশের আর্থ সামাজিক পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে ক্যাডেট কলেজসমূহের পেছনে ব্যয়িত আর্থিক খরচের যথার্থতা আজ প্রমাণিত হয়েছে।

লেখক : লে. কর্নেল ওয়ালিউল্লাহ (অব.)

অধ্যক্ষ (এস ও এস হারম্যান মেইনার কলেজ), কলাম লেখক

 

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন!
অনুগ্রহ করে এখানে আপনার নাম লিখুন